স্বদেশ ডেস্ক:
কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। অন্যদিকে গরিবের জন্য ওএমএসের (খোলা বাজারে বিক্রি) চাল বিক্রি হচ্ছে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার বাইরেও। কিন্তু এই ‘বাম্পার ফলন’ কিংবা ‘ভালো উদ্যোগেও’ চালের বাজারে লাগাম টানা যাচ্ছে না। এমনও ঘটেছে, দু-একদিনের ব্যবধানে চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেড়ে গেছে। চালের বাজারের এই অস্থিরতা নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারও দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছে। কেন চালের দাম বাড়ে- আমাদের সময়ের পক্ষ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। উত্তর খুঁজতে গিয়ে ‘সরিষার মধ্যেই ভূত’ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, বেশি লাভের আশায় অবৈধভাবে চালের মজুদ রেখে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়াই চালের বাজারের অস্থিরতার অন্যতম কারণ। আর অবৈধ মজুদের ক্ষেত্রে খাদ্য বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মজুদকারীদের যোগসাজশও রয়েছে। মজুদ নীতিমালা উপেক্ষা করে অনুমোদিত পরিমাণের বেশি চাল মজুদ রেখে বাজারে সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ায় সিন্ডিকেট। আর মাঠপর্যায়ের এই অসাধু কারবারিদের তথ্য খোদ খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারাই গোপন রাখেন। এর ফলে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তর চাল ব্যবস্থাপনার সঠিক চিত্র দেখতে পাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, মজুদদারদের সঙ্গে কারসাজিতে জড়িত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা তথ্য সংগ্রহ করছে। এ ছাড়া জড়িত কর্মকর্তাদের সম্পদের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোয়েন্দা ইউনিট।
দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অভিযোগ, মাঠপর্যায়ের খাদ্য কর্মকর্তারা ধান-চাল উৎপাদন, বিপণন ও বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে সঠিক তথ্য দিয়ে খাদ্য অধিদপ্তরকে সহযোগিতা করছে না। এমনকি যারা অবৈধভাবে ধান-চালের মজুদ রাখে, তাদের বিষয়ও গোপন করেন তারা। খাদ্যমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও তারা অবৈধ মজুদদারদের তথ্য জানাচ্ছেন না। শুধু সংশ্লিষ্টদের দেখানোর উদ্দেশ্যে দু-এক জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে। সঠিক তথ্য না পাওয়ায় মজুদদারদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না।
মজুদদারদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগ অস্বীকার করে রাজশাহীর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক জিএম ফারুক হোসেন পাটওয়ারী আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় অভিযান চালিয়েছি। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে একজন মিলার ও দুজন ব্যবসায়ীকে অবৈধ মজুদদারির অপরাধে জরিমানা করা হয়েছে। দুই ব্যবসায়ীর লাইসেন্সও ছিল না। পরে তাদের কাছে থাকা মজুদ চাল ভ্রাম্যমাণ আদালতের উপস্থিতিতে বাজারজাত করা হয়েছে। এ ছাড়া নওগাঁয় তিন মিলারের সন্ধান পেয়েছি, যারা অবৈধভাবে মজুদ রেখেছেন। তাদেরও জরিমানা করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দেখেছি অনেক স্থানে লাইসেন্স ছাড়াই অনেকে ব্যবসা করছেন। অবৈধভাবে মজুদ রেখেছেন। মজুদ নীতিমালা অনুযায়ী অতিরিক্ত চাল মজুদ রাখলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।’
কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চলতি মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অন্য কোনো কারণে ধানের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ফলে দেশে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। গত বছর দেশে ৩ কোটি ৭৬ লাখ টন চালের উৎপাদন হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংগ্রহ অভিযানও বেশ ভালো। দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়েও খোলা বাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) হচ্ছে। তবু বাজারে চালের দাম কিছুতেই কমছে না। প্রতি সপ্তাহেই চালের দাম বাড়ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না।
জানা গেছে, চালের বাজারের অস্থিরতা নিয়ে গত ২৭ ডিসেম্বর এক সভায় খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার অবৈধ মজুদদারদের তথ্য জানাতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। অনুমোদিত পরিমাণের বেশি খাদ্যশস্য অবৈধভাবে মজুদকারীদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ৭ জানুয়ারির মধ্যে মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরে পাঠাতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু তার নির্দেশনার দুই মাস পেরিয়ে গেলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। অবৈধ মজুদদারদের তথ্য পাঠাননি কর্মকর্তারা। এরপর থেকেই সন্দেহের তালিকায় পড়েন জেলা খাদ্য কর্মকর্তারা।
সভায় খাদ্যমন্ত্রী বলেন, বাজারে চালের অভাব নেই। মিল মালিকদের অবৈধ মজুদের কারণেই দাম বাড়ছে। তারা ধীরে ধীরে চাল ছাড়ছে। সাধারণ মানুষের কথা মাথায় নিয়ে এখনই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। না হলে সামনে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ৭ জানুয়ারির মধ্যে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের সংশ্লিষ্ট জেলায় কারা ধান-চালের ব্যবসা করছে তার তথ্য বের করতে হবে। এর মধ্যে কারা অবৈধভাবে ধান-চালের মজুদ করছে তা জানাতে হবে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রককে। কেউ মজুদ না করলে সেটাও জানাতে হবে। পরে মজুদদারদের তালিকা অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করা হবে। তবে কোনো জায়গায় মজুদ করছে না বলে প্রতিবেদন দেওয়ার পর, সেখানে মজুদ পাওয়া গেলে সেই কর্মকর্তাকে ধরার কথাও বলেন মন্ত্রী। কর্মকর্তাদের সাধনচন্দ্র মজুমদার বলেন, ধানের বাজার মিলাররা নিয়ন্ত্রণ করছে। চিকন চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে করপোরেট ব্যবসায়ী ও অটোরাইস মিলাররা। মিল মালিক ও আড়তদাররা চাল মজুদ করে মৌসুমের শেষ সময়ে দাম বাড়িয়ে তা বাজারে ছাড়ে। গত বছর অভিযানের মাধ্যমে এমন অনেক মজুদের চাল বের করা হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম আমাদের সময়কে বলেন, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেও দামে প্রভাব পড়েছে। সরু ও মোটা চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি বলেন, দেশে ধান-চালের বাম্পার ফলনের পাশাপাশি বাম্পার চাহিদাও বেড়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরে চাল যাচ্ছে। এ ছাড়া নন-হিউম্যান কনজাম্পশন বেড়েছে। সব মিলিয়ে উৎপাদনের পাশাপাশি চালের ব্যবহারও অনেক গুণ বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বলেছি যদি কেউ অবৈধভাবে চালের মজুদ রাখে তা হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু কর্মকর্তারা সে রকম অবৈধ মজুদদারদের খোঁজ পাননি। তবে রাজশাহী বিভাগে কয়েকজন অবৈধ মজুদকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ৩ দিনের মধ্যে তাদের কাছে থাকা মজুদ চাল বাজারজাত করা হয়েছে।’
বর্তমানে মিনিকেট ও নাজিরশাইল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা, আমন পাইজাম ৫২ থেকে ৫৫ টাকা, স্বর্ণা ৪৮ থেকে ৫২ টাকা এবং বিআর ৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে সরু এবং মোটা চালের দাম ৭ থেকে ৮ শতাংশের মতো বেড়েছে। কিন্তু কালোবাজারিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ২০০৪ সাল থেকে ২০২২ বছর পর্যন্ত প্রতিবছরই গড়ে আগের বছরের তুলনায় সব ধরনের চালের দাম ৮ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ বেড়েছে। তবে এর মধ্যে ২০১২ সালে মিনিকেট, নাজিরশাইল, আমন পাইজাম, পারিজা, স্বর্ণা এবং বিআর ১১, বিআর-৮ চালের দাম গড়ে সাড়ে ৯ শতাংশ কমেছিল। এ ছাড়া ২০১৫ সালে আগের বছরের তুলনায় গড়ে সাড়ে ৫ শতাংশ দাম কমে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে এসব চালের দাম গড়ে ১৬ শতাংশের বেশি কমে। এরপর বিশ^ব্যাপী করোনা মহামারীতে আর চালের দাম কমেনি, বরং প্রত্যেক সপ্তাহেই বেড়ে চলেছে। বাড়তে বাড়তে বর্তমানে সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে চালের বাজার।
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, গত ১৬ বছরে অর্থাৎ ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চালের উৎপাদন বেড়েছে ৪২ শতাংশ। চলতি আমন মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। দেশের ধান-চালের ঘাটতি নেই। তবু দামের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।
কর্মকর্তাদের ভাষ্য, দাম বৃদ্ধির পেছনে চালের কালোবাজারি অর্থাৎ সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটই দায়ী। এই সিন্ডিকেটের তালিকা করতে জেলা পর্যায়ের খাদ্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হলেও তারা তালিকা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে যেসব জেলায় বেশি পরিমাণে চাল উৎপাদন হয়, সেসব জেলায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের উপপরিচলক (সরবরাহ, বণ্টন ও বিপণন) মো. আফিফ-আল-মাহমুদ ভূঁঞা আমাদের সময়কে বলেন, মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারা বিভিন্ন স্থানে অবৈধ মজুদদারির বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছেন। রাজশাহী বিভাগে কয়েকজনকে জরিমানা করার কথা জানান তিনি।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের দাবি, গত ১৩ বছরে সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের কোনো সংকট হয়নি। ফলে কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে যেখানে চালের উৎপাদন ছিল মাত্র ২ কোটি ৬৫ লাখ টন, সেখানে ২০২১ সালে চালের উৎপাদন ৪২ শতাংশ বেড়ে ৩ কোটি ৭৬ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে।
একজন মিলারের দাবি, চলতি মৌসুমে ফসলের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পরিবহন খরচ কিন্তু বেড়েছে। কমপক্ষে চার হাত বদল হয়ে বাজারে চাল আসে। ফলে খুচরা বাজারে চালের দাম বেড়েছে। ট্রেডিং ব্যবসায়ীরা ধান ক্রয় করে কৃষকের ঘরে মজুদ করেও চালের দাম বাড়াচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আড়তদার বলেন, মিল থেকে পুরাতন সরু চাল বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। নতুন চাল বাজারে কম আসছে। যেসব ছোট মিল বন্ধ, তারাও ধান কিনে মজুদ করে রেখেছে। এ ছাড়া বড় বড় মিলার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কৃষকের গোলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধান মজুদ করে রাখেন এবং বাজারে দাম বাড়লে বিক্রি করেন। মিলাররা নতুন আমন চাল বাজারে না ছেড়ে মজুদ করে রেখেছেন বলেও মনে করেন এই ব্যবসায়ী।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ও ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মানুষের খাদ্য নিয়ে যদি কোনো কর্মকর্তা কারও সঙ্গে কারসাজি করেন বা চালের তথ্য গোপন করেন, তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।